বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার সেকাল একাল | লেখক- নবী হোসেন মাছুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় | Provat Bangla tv

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার 
সেকাল একাল Provat Bangla tv 



বাংলাদেশে সাম্প্রাদায়িকতার সেকাল একাল

সর্বকালের সেরা নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার ইহুদি পরিচিতির কারণে নাৎসি আমলে জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ নাৎসি শাসিত সবগুলো অঞ্চলে তার লেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। শুধু কি তাই? তার ও তার পরিবারের উপর নানা ধরনের নির্যাতন করা হলে আইনস্টাইন অবশেষে দেশ ও জার্মানির নাগরিকত্ব ছাড়তে বাধ্য হন। তারপর ১৯৪০ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর তাকে শরণার্থী জীবনযাপন করতে হয়।

আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার পথিকৃৎ ইটালিয়ান চিন্তাবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলেই প্রচলিত গৎবাঁধা বিশ্বাসকে নস্যাৎ করে যখন বলেন- সূর্য পৃথিবীর চারদিকে নয় বরং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। তখন তার এই তত্ত্বকে ধর্ম অবমাননার শামিল করে তাকে অপরাধী ও ধর্ম অবমাননাকারীর দায় দেয়া হয়।

আর সক্রেটিসকে তো নকল ঈশ্বরের উপাসনা ও তরুণদের ভুল পথে পরিচালিত করার অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিষপান করতে হয়েছিলো।

একই ধাঁচের তিনজন ব্যক্তির জীবনাংশ এখানে উল্লেখ করার কিছু প্রাসঙ্গিকতা আছে। তাদের উদ্ভাবিত মৌলিক ও সত্য তত্ত্বগুলোর সুফল আমরা আজকের দুনিয়ায় ভোগ করলেও তৎকালীন কেউ সেসব তথ্য ও তত্ত্ব মেনে নিতে পারেনি। ভেতরের মগজ কেউ কাজে না লাগিয়ে সবাই শৌর্য- বীর্য, বয়কট আর উগ্রতাকে কাজে লাগিয়েছে। কাউকে শরণার্থী বানিয়েছে, কেউ অবশেষে বিষপান করেছে। এতকিছুর পিছনে সোজা কারণ একটিই ধর্ম অবমাননা।

ধর্ম অবমাননাকে আমরা কত ঠুনকো বানিয়ে ফেলেছিলাম, ফেলেছি !

সাম্প্রতিক সময়ে নড়াইল, কুমিল্লা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া,পাবনা, ফেনীতে হিন্দুদের বসতবারি,ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, আগুন দেওয়া, নওগাঁয় সাঁওতাল কৃষকদের হত্যা, দিনাজপুরে কান্তজির মন্দির উচ্ছেদ চেষ্টা, মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অবমাননাসহ যেসব অপকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার সবগুলোর পিছনেই কারণগুলো খুব তুচ্ছ। কখনো সোশ্যাল মিডিয়াই পোস্ট,কখনো গুঁজব, কখনো রাজনৈতিক চাল,কখনো মিথ্যাচার আর এসব বিষয় বিচার বিবেচনা না করেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি একে অন্যের উপর।

কিন্তু বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবেন? হিন্দুদের পূজা মণ্ডপে ভাঙচুর করে, মূর্তি পুড়িয়ে আমরা কতজন অমুসলিমকে নব্য মুসলিম বানাতে পেরেছি ? একই সাথে সনাতনীদের নিকট জিজ্ঞাসা- ভেতরের ঘটনা বিবেচনা না করেই সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের যে অতিরঞ্জিত বক্তব্য আপনারা দেশে বিদেশে পেশ করে থাকেন, তাতে কতজন মানুষকে দেশছাড়া বা গৃহবন্দী করতে পেরেছেন? তাহলে কেনো এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা , কেনো এতো সহিংসতা। অথচ হাজার হাজার নথি আছে যে, ধীরতা, স্থিরতা,উদারতা, সহনশীলতা,সহমর্মিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধায় আকৃষ্ট হয়ে বহু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছে, উগ্রতা কিংবা সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে নয়।

রবীঠাকুর বলেছিলেন- “আগে জাতিক হও, পরে আন্তর্জাতিক হইও“। উক্তিটি বাংলা ভাষাকে নিয়ে করলেও এঁর যথোপযুক্ততা এখন সাম্প্রাদায়িক বিচ্ছিন্নতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা জাতিক হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক হওয়ার চেষ্টা করি। অথচ যুগ যুগ ধরে জাতিগত একতা, ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতাই ছিল আমাদের প্রধান শক্তি। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন রাজসাক্ষী ফরাসি দার্শনিক বেরনার অরি লেভি  বলেন- “ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি ছিলো দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া“। তখন ছিল ১৯৭১ সাল আর এখন ২০২২। জিডিপি আর জীবন মানের প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের মনুষ্যত্ববোধ এর প্রবৃদ্ধি কেন ঘটেনি ?

বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে একটি বহুধর্মীয় দেশ। এখানে একটি সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় তখনি উগ্র হয়ে উঠে যখন তারা নিজেদেরকে আলাদা একটা  শক্তি ভাবে আর এটা ভাবার পিছনে কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের “হিপোক্রেসি”। ভোটের সময় আমরা নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে যখন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করি, তখনি তারা নিজেদেরকে আলাদা একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে আবিষ্কার করে এবং পান থেকে চুন খসলেই তারা উগ্রবাজ ও অস্ত্রবাজ হয়ে উঠে। সুতরাং এই জায়গাটিতে আমাদের রাজনীতিবিদদের আরেকটু সচেতন হওয়া জরুরি।

চাইলেই ধর্মীয় সহিংসতা বৈধ হলে ১৪০০ বছর আগে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিদায় হজ্বের ভাষণে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির বিষয়ে নিষেধ করতেন না। ধর্মকে আমাদের  বিশ্বাসের মাপকাঠিতে পরিমাপ করা উচিত কেনোনা সব ধর্মই শান্তির ,মুক্তির ও কল্যাণের পতাকাবাহী। ধর্মের নামে মানুষ নিধন করে কেউ ধর্মপ্রাণ হতে পারে না, হয়ে উঠে স্বার্থান্ধ ধর্মব্যবসায়ী।

মানুষের সত্যিকারের ধর্ম হল “ মাথার ভিতরকার মগজ, যেটা অদৃশ্য, যে পরিচয়টি মানুষের অন্তর্যামীর কাছে ব্যক্ত”।
সুতরাং, ধর্মীয় ও সাম্প্রাদায়িক সহিংসতা ছেড়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে ঐতিহ্যে যখন আমরা এই উপমহাদেশে মুসলমান,হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান সবাই কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে বসবাস করতাম। আমাদের সম্প্রীতি আমাদেরকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের মধ্যে থাকতে হবে পারস্পরিক সমঝোতা, সহমর্মিতা ও অবিরাম শ্রদ্ধা। সম্প্রীতি নিয়ে কবি মাসুূদ খান খুব সুন্দর করে লিখেছেন –
"একটি আঙ্গুল আঘাত পেলে,অন্য আঙ্গুল এগিয়ে যায়,
সমদুঃখে সমব্যাথায়,দরদ ভরা হাত বোলায়।
হোক না আঙ্গুল নানা রকম,কেউ পিছে কেউ আগে, ভাত খেতে গেলে কিন্ত পাঁচটা আঙ্গুলই লাগে "।



লেখক- 
নবী হোসেন মাছুম, 
শিক্ষার্থী, 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সম্পাদনায় 
ইয়াসির আরাফাত শুভ 

Comments